রাজধানীর উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে প্রকাশ্যে এক দম্পতিকে কোপানোর ঘটনায় মূল অভিযুক্ত মেহেদী হাসান সাইফ (২৪) যুবলীগের সক্রিয় কর্মী। তিনি স্থানীয় একটি কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান হিসেবেও পরিচিত। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সাইফসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে।
গ্রেফতারকৃত অন্য চারজন হলেন—মো. মোবারক হোসেন (২৫), রবি রায় (২২), মো. আলফাজ মিয়া ওরফে শিশির (২২) এবং সজীব (২০)। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা হামলার দায় স্বীকার করেছে এবং নিজেদের অপরাধ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় কিশোর গ্যাং ও সাইফের পরিচয়
স্থানীয় সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত সাইফ ও সজীব সহোদর। তারা আব্দুল্লাহপুর খানবাড়ি এলাকায় ভাড়া থাকতেন এবং এলাকায় বেপরোয়া চলাফেরার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই উগ্র স্বভাবের সাইফ উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের যুবলীগ নেতা সোহেল ও মনিরুজ্জামানের অনুসারী ছিলেন এবং নিয়মিত যুবলীগের মিটিং-মিছিলে অংশ নিতেন। পাশাপাশি তিনি একটি কিশোর গ্যাং পরিচালনা করতেন, যারা উত্তরা এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল।
কিভাবে হামলার ঘটনা ঘটে
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রওনক জাহান সংবাদ সম্মেলনে জানান, সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে এক দম্পতিকে কুপিয়ে আহত করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশের একটি টহল দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে জনগণের সহায়তায় মোবারক হোসেন ও রবি রায়কে গ্রেফতার করে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মেহেবুল হাসান (৩৭) ও নাসরিন আক্তার ইপ্তি (২৮) উত্তরা পশ্চিম থানাধীন আমির কমপ্লেক্স থেকে কেনাকাটা করে বাসায় ফিরছিলেন। এসময় তিন ব্যক্তি দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে এলোমেলোভাবে যাচ্ছিল এবং একটি রিকশাকে ধাক্কা দেয়। রিকশায় থাকা শিশুর বাবা প্রতিবাদ করলে তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।
এই সময় ভুক্তভোগী দম্পতি পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলে মোটরসাইকেল আরোহীরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। প্রথমে তারা মেহেবুল হাসানকে মারধর শুরু করে এবং ফোন করে আরও সহযোগীদের ডেকে আনে। কিছুক্ষণের মধ্যে সাইফ, আলফাজ ও অন্যান্য সহযোগীরা রামদা হাতে ঘটনাস্থলে হাজির হয় এবং ভয় সৃষ্টি করে। এরপর তারা মেহেবুল হাসানকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। স্ত্রী নাসরিন আক্তার ইপ্তি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে তাকেও কুপিয়ে আহত করা হয়।
গ্রেফতার ও উদ্ধার অভিযান
মঙ্গলবার বিকেলে আব্দুল্লাহপুর পশ্চিমপাড়া থেকে আলফাজ মিয়া ওরফে শিশিরকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার গভীর রাতে গাজীপুরের কোনাবাড়ী থেকে সজীবকে এবং বৃহস্পতিবার ভোরে টঙ্গীর মাজার বস্তি থেকে মূল অভিযুক্ত মেহেদী হাসান সাইফকে গ্রেফতার করা হয়। সাইফের কাছ থেকে হামলায় ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ও ঘটনাস্থলে তার পরিহিত শার্ট জব্দ করা হয়। এছাড়া আলফাজ ও সাইফের তথ্যে তুরাগ নদীর পাড় থেকে হামলায় ব্যবহৃত দুটি রামদা উদ্ধার করা হয়।
ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজার আদালত সাইফ, আলফাজ ও সজীবকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন। অপরদিকে, মোবারক হোসেন ও রবি রায়ের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা আসলেই স্বামী-স্ত্রী?
এ ঘটনায় নতুন বিতর্ক দেখা দিয়েছে, কারণ আহত ব্যক্তির স্ত্রী দাবি করে এক নারী অভিযোগ তুলেছেন। শম্পা বেগম নামের ওই নারী সাংবাদিকদের জানান, হামলার শিকার হওয়া মেহেবুল হাসান তার স্বামী এবং নাসরিন আক্তার ইপ্তিকে তিনি চেনেন না।
তিনি বলেন, “২০১৬ সালে আমার সঙ্গে মেহেবুলের বিয়ে হয়, আমাদের দুটি সন্তান আছে। আমি হামলার ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে তাকে ফোন দিই, কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।”
এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “ভিকটিমরা স্বামী-স্ত্রী কি না, সেটি আমাদের তদন্তের মূল বিষয় নয়। তবে তারা মামলার এজাহারে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু নতুন এক নারী মেহেবুল হাসানের স্ত্রী দাবি করছেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।”
তবে পুলিশ জানিয়েছে, নাসরিন আক্তার ইপ্তি যদি মেহেবুল হাসানের স্ত্রী নাও হন, তবুও তিনি একজন আহত ভুক্তভোগী এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
উপসংহার
উত্তরায় প্রকাশ্যে দম্পতিকে কোপানোর ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধীদের বেপরোয়া আচরণ আবারও সামনে এসেছে। পুলিশের তদন্তে এই ঘটনার পেছনের মূল কারণ ও আরও তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।
/হুজায়ফা ইয়ামান